Wednesday, July 11, 2012

প্রয়োজনে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে: সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা


বৃহস্পতিবার | ৫ জুলাই ২০১২ | ২১ আষাঢ় ১৪১৯
Copy_of_pmo-------_0012----3-4

পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করার সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা দরিদ্র হতে পারি। প্রয়োজনে রিজার্ভ থেকে বছরে এক-দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করা মোটেই কষ্টের কিছু নয়। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে অপবাদ দিয়েছে। বাংলাদেশের দুর্নীতির বিষয়ে তারা কথা বলেছে; কিন্তু তাদের দুর্নীতি কে দেখে? বুধবার বিকেলে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সাপ্তাহিক প্রশ্নোত্তরে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। শনিবার বিশ্বব্যাংক সরকারের সঙ্গে ঋণচুক্তি বাতিল করার পর এই প্রথম কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে আগামী ৮ জুলাই বাজেট অধিবেশনের শেষদিন তার বক্তৃতায় এসব বিষয়ে আরও বিস্তারিত বলবেন বলেও জানান তিনি।

পদ্মা সেতুর নতুন সম্ভাবনা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরই মধ্যে মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। আরও দেশ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হবে; কিন্তু যে দেশই প্রস্তাব দিক, তা আমাদের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও আমরা যদি নিজেদের অর্থনীতি ধরে রাখতে পারি, তাহলে পদ্মা সেতু করতে পারব না, এটা হয় না। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে নিজেরাও বিনিয়োগ করব। গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট খাতের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন বলে সংসদকে জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকবার অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত এমপিরা টেবিল চাপড়ে তাকে অভিনন্দন জানান।




প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতির কথা বলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে অপবাদ দিয়েছে। বাংলাদেশের দুর্নীতির বিষয়ে তারা কথা বলেছে; কিন্তু তাদের দুর্নীতি কে দেখে? ওয়ার্ল্ডস্ট্রিট জার্নাল এবং ফোর্বস পড়লেই এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি। সেই বিএনপির আমল থেকে বাংলাদেশের যোগাযোগ খাতে তারা একটি পয়সাও ছাড় দেয়নি। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, যেখানে একটি টাকাও ছাড়া করা হয়নি, সেখানে দুর্নীতির প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? তা ছাড়া বিশ্বব্যাংকের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে এবং অন্য কেউ এর পেছনে আছে কি-না সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে।


বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি এবং অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ করলেও গতকাল প্রধানমন্ত্রী নিজেই বরং এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের 'দুর্নীতিচেষ্টা'র অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকই বরং এ প্রকল্পে কাজ দিতে একটি ভুয়া কোম্পানির পক্ষে অন্তত তিনবার সরকারকে চিঠি দিয়েছে। বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য কমিশন গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ কমিটিতে বিশ্বব্যাংকেরও পরামর্শক ছিল। বিশেষ একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে বিশ্বব্যাংক তিনবার চিঠি দিয়েছে। কিন্তু ওই কমিটি তদন্ত করে দেখেছে ওই কোম্পানিটিই ভুয়া। ভুয়া কোম্পানিকে কাজ দিতে তিন-তিনবার চিঠি দিয়ে চাপ দেওয়া হলেও ওই কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয়নি_ তবে দুর্নীতিটা হলো কীভাবে?


তিনি বলেন, দুর্নীতি তদন্তের সুবিধার্থে মন্ত্রী-সচিব-প্রকল্প পরিচালককে সরিয়ে দিয়েছি, এর চেয়ে আর বেশি কোন সরকার করেছে? এ প্রসঙ্গে তিনি চারদলীয় জোট সরকারের উল্লেখ করে বলেন, তাদের সময়ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী-উপদেষ্টার বিষয়ে নানা অভিযোগ এসেছে। কিন্তু কাউকে পদত্যাগ করতে হয়নি বা কাউকে সরিয়েও দেওয়া হয়নি।


গতকাল বিষয়টির অবতারণা করেন স্বতন্ত্র এমপি মো. ফজলুল আজিম। সম্পূরক প্রশ্নে তিনি অর্থবছরের শুরুতেই বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে ধাক্কা খাওয়া এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে বিকল্প ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। একই সঙ্গে যে মন্ত্রীর জন্য দেশের এমন ভোগান্তি তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে কি-না সে সম্পর্কে জানতে চান তিনি। ১৮ মিনিটে এ প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর দেন সংসদ নেতা। এ সময় সংসদে সভাপতিত্ব করছিলেন ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী।


প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বমন্দার মধ্যেও যদি আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারি তবে নিজের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারব। বিশ্বব্যাংকসহ আরও যারা আছে তারা ঋণ দেওয়া বন্ধ করলে করতে পারে, করুক। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য আমাদের সঙ্গে দেশের ১৬ কোটি জনগণ এবং বিদেশে ৮০ লাখ প্রবাসী আছে। তা ছাড়া দেশের অর্থনীতির অবস্থাও এত খারাপ নয়।


পদ্মা সেতু নিয়ে এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ বিভাগের সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব এবং সেতু বিভাগের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেছেন বলেও সংসদকে জানান। নিজস্ব অর্থায়নে কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে দেশের রিজার্ভ এবং অন্যান্য সম্ভাবনা বিষয়ে এখানে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।


শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো মন্ত্রী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। যে কোনো বিষয়ে যে কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যখনই দুর্নীতি প্রমাণ হবে, সে মুহূর্তে মন্ত্রিত্ব চলে যাবে। আওয়ামী লীগেরই ২৩৩ জন এমপি রয়েছেন। তাই মন্ত্রী হওয়ার মতো যোগ্য নেতার অভাব নেই। অনেকের এখনও মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে বলে জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়া সরকার এগিয়ে এসেছে। এক্ষেত্রে তিনি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ও বিওটি পদ্ধতির পাশাপাশি আরও নতুন পদ্ধতিতে সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতার কথা জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোনো পদ্ধতিতেই পদ্মা সেতু হতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশেই অনেক বড় বড় প্রকল্প এমনভাবে হয়, যেখান থেকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি তাদের খরচের টাকা তুলে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন, কোনোভাবেই জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে নয়। বরং যে-ই প্রস্তাব দিক, তা দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।


একই সময় প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারের নাম ভাঙিয়ে কেউ অবৈধ কোনো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি সংসদের ৩৫০ এমপিকে সাক্ষী রেখে সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন আচরণ করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে তিনি সবাইকে তার ব্যক্তিগত ই-মেইল আইডি এবং দুটি মোবাইল ফোন নম্বর জানিয়ে দেন। বলেন, তার বা তার পরিবারের নাম ভাড়িয়ে কেউ কোনো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলে ংযবরশযযধংরহধ@যড়ঃসধরষ.পড়স ই-মেইল আইডিতে তা যেন জানানো হয়। এ সময় তিনি তার দুটি ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বর (০১৭১১৫২০০০০, ০১৮১৯২৬০৩৭১) দিয়ে বলেন, প্রয়োজনে এখানে এসএমএস করে অভিযোগ জানাতে পারেন। তবে পরিবার বলতে তিনি তাদের দুই বোন এবং দুই বোনোর পাঁচ সন্তানকে বোঝান। তিনি বলেন, এর বাইরে তার পরিবারের কেউ নেই।


প্রধানমন্ত্রী তার প্রশ্নোত্তরের বিভিন্ন পর্যায়ে চারদলীয় জোট সরকারের দুর্নীতির কথাও তুলে আনেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার তাদের প্রথম দফায় পদ্মা সেতু নির্মাণে জাপানের সঙ্গে কাজ শুরু করলেও ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে না পারার কারণে সব বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের দুর্নীতির কারণেই তখন পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ আর শুরু হয়নি। ফলে আমরা অনেক পিছিয়ে যাই। অথচ এর আগেই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।


পদ্মা সেতু নির্মানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার ক্ষমতায় আসার পর পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলে বিশ্বব্যাংক স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই এগিয়ে আসে। তাদের প্রস্তাব গ্রহণও করা হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই কথা নেই, বার্তা নেই, বলা হলো_ এখানে দুর্নীতি হয়েছে! তিনি বলেন, যেখানে অর্থই ছাড় দেওয়া হয়নি, একটি পাই-পয়সাও বিশ্বব্যাংক দেয়নি, সেখানে দুর্নীতিটা কোথায় হলো? তিনি বলেন, বর্তমান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করে। বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে, তাদের লোক এসেও খোঁজখবর নিয়েছে। তারা নিজেরাই বলেছেন, এখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি। পৃথিবীর সব জায়গায় ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়; কিন্তু বাংলাদেশে তা হয়নি।


প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসাবেলা ঢাকায় এলে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি আমাকে দুটি কাগজ ধরিয়ে দেন। ওই দুই কাগজ পড়ে দেখা গেছে, দুর্নীতির অভিযোগটি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। আমাদের কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নয়। এটা তাকে আমি দেখিয়েছি। তখন ইসাবেলা বললেন, আরও তথ্য আছে। এরপর তাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ চাওয়া হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।


তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন কি ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া বা সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল? যোগাযোগ খাতের সাতটি প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে অর্থায়ন বন্ধ করা হলো, তাদের বিরুদ্ধেও কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? বিএনপি সরকার কোনো ব্যবস্থা না নিলেও আমরা নিয়েছি। কারণ আমরা জনগণের জন্য রাজনীতি করি, তাদের জন্য কাজ করি। ক্ষমতায় আমরা দু'পয়সা কামাই করতে আসিনি, আমরা কমিশনও খাই না। বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমাদের সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজেছে, কিছু কি পেয়েছে? কেউই পায়নি।


প্রধানমন্ত্রী বলেন, '৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর কৃষি খাতে ভর্তুকি দিতে গেলেও বিশ্বব্যাংক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এবার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে চাইলেও তারা আপত্তি জানিয়েছে; কিন্তু সেটা আমরা আমলে নিইনি। এবার দরকার হলে নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির যে অপবাদ দিয়েছে তা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়।


প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর আগে জোট সরকারের সময় ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কাজ শুরু হলেও তারা অর্থায়ন বন্ধ রাখে। পরে নিজেদের অর্থেই এ প্রকল্পের কাজ হয়েছে।


ঢাকার যানজট নিরসনে ব্যাপক পদক্ষেপ : ঢাকার যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকার জনসংখ্যার বাড়তি চাপের কারণে বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা প্রকট হওয়ার পাশাপশি অন্যান্য নাগরিক সুবিধা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। তবে মন্ত্রণালয়গুলো স্থানান্তর নয়, স্থানীয় সরকারকে বিকেন্দ্রীকরণ ও শক্তিশালী করলেই ঢাকামুখী জনস্রোত রোধ করা সম্ভব হবে।









                                  সূত্র
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ


No comments:

Post a Comment